গুড় উৎপাদন
স্বাস্থ্যসম্মত খেজুরের সিরাপ ও গুড় উৎপাদন প্রযুক্তি
স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত মানের গুড় বা সিরাপ উৎপাদনের জন্য রস সংগ্রহ প্রক্রিয়া অত্যমত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যসম্মত খেজুরের সিরাপ ও গুড় উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
রস সংগ্রহের পর পরিস্কার কাপড় দিয়ে রস ছেকে চুলার উপর বসানো লোহার বা স্টিলের কড়াইতে ঢালা হয়। চুলার উপর কড়াই বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কড়াই ও চুলার মাঝে কোন ফাঁকা জায়গা না থাকে। আরও খেয়াল রাখতে হবে চিমনী থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে কড়াইয়ের রসের সঙ্গে মিশতে না
চিত্র ১৪ঃ সিরাপ/গুড় তৈরীর চুলা |
পারে। রস জ্বাল দেয়ার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে যে গাদ বা ফেনা ভেসে উঠে তা যত দ্রম্নত সম্ভব ছাকনি বা হাতা দিয়ে ফেলে দিতে হবে। গাদ বা ফেনা ফেলতে দেরী হলে তা রসের সাথে মিশে জটিল অপরিশোধনযোগ্য অবস্থায় চলে যাবে। রস ঘনীভূত হলে ঘনীভূত রস হাতা দিয়ে অল্প তুলে ফোটা ফোটা ফেলে দেখতে হবে শেষের ফোটার আঠালো ভাব দেখা যায় কিনা।
চিত্র ১৫ঃ খেজুরের রস জ্বালকরন |
চিত্র ১৬ঃ খেজুরের সিরাপ প্রস্ত্ততকরন |
ঘনিভূত রস আঠালো বা সিরাপের মত দেখা গেলে এই অবস্থায় নামিয়ে সিরাপ তৈরী করতে হবে। আবার সিরাপের ঘনত্ব ( ব্রিক্স % ) পরিমাপ করেও সিরাপ তৈরী যায়। সাধারনতঃ সিরাপের ঘনত্ব ( ব্রিক্স % ) ৭৫-৮০% ব্রিক্স হলে চুলা থেকে নমিয়ে সিরাপ তৈরী করা যায়।
চিত্র ১৭ঃ খেজুরের সিরাপ বোতলজাতকরন |
গুড় তৈরী করতে চাইলে এই অবস্থায় কড়াইয়ের ফুটমত্ম ঘনীভূত রস হাতলের সাহায্যে লাগাতর নাড়তে হবে এবং চুলার তাপমাত্রা দ্রম্নত কমিয়ে আনতে হবে। চুলা থেকে নামানোর সময় নিশ্চিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে সামান্য গুড় অর্থাৎ এক চিমটি পরিমাণ গুড় কিছু ঠান্ডা পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। গুড় দ্রম্নত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে এবং চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে দ্রম্নত ঠান্ডা করতে হবে।
চিত্র ১৮ঃ প্রস্ত্ততকৃত খেজুরের গুড় |
চিত্র ১৯ঃ বিভিন্ন প্রকারের খেজুরের গুড় |
খেজুর চাষীরা অতি সহজেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সিরাপ বা গুড় তৈরী করে অধিক লাভবান হতে পারবেন। লাভজনক লাগসই এই প্রযুক্তি খেজুর গুড় প্রস্ত্তত এলাকায় ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসম্মত সিরাপ বা গুড় উৎপাদন করতে পারেন। জীবাণুমুক্ত পরিবেশে সিরাপ বোতলজাত করতে হবে এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সিরাপ জীবণুমুক্ত বোতলে ঢেলে সঙ্গে সঙ্গে সিপি লাগিয়ে দিতে হবে।
চিত্র ২০ঃ খেজুরের গুড় বাজারজাতকরন |
দানাদার গুড় তৈরী ও প্যাকেজিং
রস ঘনীভূত হওয়ার সাথে সাথেই হাতলের সাহায্যে ঘনীভূত রস ঘন ঘন নাড়তে হবে এবং সঠিক তাকে ঘনীভূত রস চুলা থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে। সঠিক সময়ে গুড় নামানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো অল্প কিছু ঘনীভূত রস ঠান্ডা পানির মধ্যে ছেড়ে দিলে সাথে সাথে গুড় জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে ঘনীভূত রস নামানোর সঠিক সময় হয়েছে। গুড়সহ কড়াই চুলার উপর থেকে নামানোর পরে হাতলের সাহায্যে নাড়তে হয়।
চিত্র ২১ঃ প্রস্ত্ততকৃত খেজুরের গুড় ঠান্ডাকরন |
চিত্র ২২ঃ প্রস্ত্ততকৃত গুড় দানাদারকরন |
|
অল্প কিছু গুড় হাতলের সাথে কড়াইয়ের এক প্রামেত্ম অনবরত ঘসে সীড তৈরী করে কড়াইয়ের গুড়ে মিশিয়ে দিতে হবে যা দানাদার গুড় হওয়ার ক্ষেত্রে তরান্বিত করবে। গুড় যখন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে জমাটবদ্ধ হতে থাকবে তখন হাতলের সাহায্যে ঘন ঘন নাড়া দিয়ে গুড়কে দানাদার পরিনত করতে হবে। দানাদার প্রক্রিয়া শেষে গুড় রৌদ্রে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
|
চিত্র ২৩ঃ গুড় প্যাকেটজাতকরন |
দানাদার গুড় প্যাকেটিং ও সংরক্ষণের জন্য ১-২ দিন প্রখর রৌদ্রে শুকাতে হবে। শুকনা গুড়ের আর্দ্রতা শতকরা প্রায় ২-৪ ভাগে নেমে আসবে। এ অবস্থায় গুড় প্যাকিং করলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। স্বচ্ছ পলিথিন প্যাকেটে দানাদার গুড় প্যাকিং করলে ভলো হয়। এভাবে শুকনো গুড় প্যাকিং করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
গুড় সংরক্ষণ
বাংলাদেশে খেজুরের গুড় সাধারণত: শীতকালে প্রস্ত্তত করা হয়ে থাকে। নভেম্বর মাস থেকে শুরম্ন করে ফেব্রম্নয়ারী-মার্চ মাস পর্যমত্ম গুড় প্রস্ত্তত করতে দেখা যায়। শীত মৌসুমে গুড় প্রস্ত্তত করা হলেও গুড়ের বিরাট অংশ খাবারের জন্য সারা বৎসরই সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। কঠিন গুড় সংরক্ষণের জন্য ভাল হলেও অর্ধতরল ও তরল গুড় মাটির পাত্রেই সংরক্ষণ বেশী করা হয়। শীত মৌসুমে সংরক্ষিত গুড়ে তেমন ক্ষতি না হলেও বর্ষা মৌসুমে সংরক্ষিত গুড়ের প্রায় ৩০ ভাগই খাবার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। খেজুরের গুড়ে অধিক রিডিউসিং সুগার (গস্নুকোজ-ফ্রূকটোজ) বিদ্যমান থাকার কারণে বর্ষা মৌসুমে বায়ু থেকে পানি শোষণ করে নেয় এবং গাজায়ে (ভবৎসবহঃধঃরড়হ) খাবার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে।
|
চিত্র ২৪ (ক)ঃ গাজনকৃত বস্নক গুড় |
চিত্র ২৪ (খ)ঃ মাটির পাত্রে গাজনকৃত গুড় |
অর্ধ তরল এবং তরল প্রকৃতির গুড় সচরাচর মাটির বড় বড় পাত্রে (৩৫-১০০ কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন) সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। মাটির পাত্রে গুড় সংরক্ষণ তুলনামুলকভাবে খরচ কম বিধায় অধিকাংশ গুড় ব্যবসায়ীরা মাটির পাত্রে গুড় সংরক্ষণ করে থাকে। কোন কোন এলাকায় ২০ কেজি ধারণক্ষম টিনের পাত্রে গুড় সংরক্ষণ করা হয় তবে এ পদ্ধতি কিছুটা ব্যয়বহুল। গুড় পরিবহণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
বিএসআরআইতে গবেষণায় দেখা গেছে রং করা মাটির পাত্রে মোম বা পলিথিন দিয়ে বা মাটি দ্বারা মুখ বন্ধ করে গুড় সংরক্ষণ করলে দীর্ঘদিন গুড় ভাল থাকে। এ পদ্ধতিতে গুড় সংরÿণের জন্য গুড়ের জলীয় অংশ শতকরা ৭ ভাগের বেশী হওয়া উচিত নয়। গুড় হাউজ নির্মাণ করে আদ্রতা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ এবং তাপমাত্রা ১০০ সে. নিয়ন্ত্রণ করলে গুড়ের ভৌত গুণাবলী দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত থকে এবং গুণগত মানের পরিবর্তন হয় না।
চিত্র ২৫ঃ মাটির পাত্রে গুড় সংরক্ষণ |
দানাদার গুড় সহজেই দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। দানাদার গুড় সংরক্ষণের জন্য দুই দিন প্রখর রৌদ্রে শুকাতে হবে এবং গুড়ের আর্দ্রতা শতকরা প্রায় ২ ভাগে নিয়ে আসতে হবে। এ অবস্থায় গুড় স্বচ্ছ পলিথিনে বিভিন্ন ওজনে প্যকেজিং করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সারা বৎসর খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করা যাবে।
চিত্র ২৬ঃ দানাদার গুড় রৌদ্রে শুকানো |
চিত্র ২৭ঃ পলিথিন প্যাকেটে গুড় সংরক্ষণ |
গুড়ের গুণগত মান
উন্নতমানের গুড়ের ভৌত গুণাবলীর মধ্যে রং, বুনট, দানার প্রকৃতি বিশেষ গুরম্নত্বপূর্ণ। গুড়ের উচ্চ মাত্রায় সুক্রোজ, খনিজ পদার্থ এবং স্বল্প মাত্রায় গস্নুকোজ-ফ্রুক্টোজ, জলীয় অংশ, অদ্রবণীয় পদার্থসমূহ সমৃদ্ধ গুড়কে উন্নতমানের গুড় বলা হয়। পক্ষান্তরে নিম্নমানের গুড়ে অধিক পরিমাণে চিনি বহির্ভূত অজৈব পদার্থসমূহ বেশী থাকে।